image

হৃদরোগ এবং হৃদরোগ এর চিকিৎসা

জীবন এবং যত্ন একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য বাধনে আবদ্ধ। যেখানেই জীবন আছে সেখানেই যন্তের প্রয়োজন আছে। এই যত্নের সূচনা হয় একটি শিশু মাতৃ গর্ভে থাকা কালীন সময় হতে। মায়ের গর্ভ হতে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যত্নের প্রয়োজন। একটি শিশু জন্মের পূর্বেই মাকে সতর্ক হতে হয় নবাগতের পুষ্টি এর ব্যাপারে। মাকে খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চার পুষ্টি ও স্বাস্থ্য যাতে ঠিক থাকে। আমাদের দেহে বেচে থাকার উপাদান গুলো সঠিক মাত্রায় থাকা প্রয়োজন, অতিরিক্ত হওয়া বা ঘাটতি রাখা যাবেনা। জীবনের পথ চলার শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সুস্থ থাকা অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু কেউ যদি দায়িত্বশীল আচরণ করে তবে অনেক অংশেই সুন্দর ও সস্থ থাকতে পারে।


কিভাবে হৃদ রোগ থেকে ভালো থাকা যায়ঃ-


জন্মগত যেসব ইন্টারভেনশন হৃদ রোগ হয় সেগুল অল্প বয়সে রোগ নির্ণয় করে শল্য চিকিৎসা অথবা ইন্টিগ্রেশন কার্ডিওলজির মাধ্যমে ছোট-খাট ছিদ্র ঠিক করা যায়। PDA, ASD, VSD, TOF (Blue Baby) সকল জন্মগত হৃদ রোগ ৯৯.৯% সফলতার মাধ্যমে আমাদের দেশেই চিকিৎসা সম্ভব, অর্থাৎ জন্মগত হৃদ রোগ সফলতার সাথে চিকিৎসা করা সম্ভব।


জন্মগত হৃদ রোগ ব্যাতিত অন্যান্য হৃদ রোগ যেমন করোনারি আর্টারি ডিফেক্ট যার কারনে হার্ট অ্যাটাক হয় সে বিষয়ে আমাদের সচেতনতা প্রয়োজন। এই সচেতনতা গুলো আমাদের সবার জানা উচিৎ।


মা বাবা কে শৈশব হতেই তাদের সন্তানের খাবার ও জীবন যাত্রার উপর নজর রাখতে হবে, যেমন কোলেস্টেরল এর মাত্রা ঠিক থাকে, ওভার ওয়েট না হয়, ধূমপান না করে। সন্তানকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যাতে জীবনে এক বারের জন্যও ধূমপান না করে। আমরা যেমন আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেই মিথ্যা না বলতে, খারাপ ও অন্যায় কাজ না করতে ঠিক তেমনি বলতে হবে ধূমপান করা নিজের প্রতি চরম অন্যায় ও অপরাধ। শখের বসতও কেউ যেন ধূমপান না করে মাদকাসক্ত না হয়। আমরা যদি একটি সুন্দর ও সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারি তাহলে বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশ গুলোকেও হার মানাবে সভ্যতায়, ভদ্রতায়, শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে।অনেক অল্প বয়স্কদের বাইপাস সার্জারি আমি করেছি, এগুলো তার পরিবারের জন্য একটি দুর্ভাগ্যর বিষয়।


শুধু শিশুরাই নয় প্রাপ্ত বয়স্কদেরও স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে, ধূমপান করা যাবেনা, অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার (ভাত, রুটি) ও রেড মিট (গরু, খাসী) কম গ্রহণ করতে হবে, ভোজ্য তেল ও লবন এর ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে যাতে শরীরে অতিরিক্ত ওজন না হয়। বিশেষ করে সতর্ক থাকতে হবে যাতে ডিসলিপিডিমিয়া বা রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেশি না হয়, যা হার্ট ব্লক এর রোগের অন্যতম কারণ। সিরাম লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষার মাধ্যমে ডিসলিপিডিয়া হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়। শুধু খাবার এর ব্যপারে সচেতন থাকলেই ওভার ওয়েট ও ডিসলিপিডিয়ার হাত থেকে তথা হৃদ রোগ হতে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়।


আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডায়াবেটিস, এটি একটি মারাক্তক মেটাবলিক অসুখ। হৃদ রোগ, অন্ধত্ব, রেনাল ফেইলিওর বা কিডনি ফেইলিওর, ব্রাইন স্ট্রোক সহ আরো অনেক জটিল রোগ ডায়াবেটিস এর কারণে হতে পারে। অতএব ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে; ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও শরীর চর্চার কোন বিকল্প নেই। নিয়মিত হাটতে হবে নিজেকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে। অনেক ডায়াবেটিস রোগীর ধারণা শুধু ইনসুলিন নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলেই হবে, কিন্তু তা ঠিক নয়। ঔষধ বা ইনসুলিন এর পাশাপাশি রোগীকে অবশ্যই হাটতে হবে। ঔষধ বা ইনসুলিন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলেও তা ডায়াবেটিস এর কারণে অন্যান্য যে রোগ গুলো হতে পারে তা প্রতিরোধ করতে পারেনা, তাই নিয়মিত হাটার কোন বিকল্প নেই। এছাড়াও হাটার মাধ্যমে হৃদ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ গুলোও প্রকাশ পায়; যেমন হাটতে গিয়ে বুক ব্যাথা হওয়া, বুকে চাপ ধরা, অল্প হাটতেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া এগুলো হতে পারে করোনারি আর্টারি ডিজিস কিংবা হার্ট অ্যাটাক এর পূর্ব সংকেত ।


আমরা যদি অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত, রুটি, রেড মিট যেমন গরুর মাংস, খাসীর মাংস কম গ্রহণ করি, ভোজ্য তেল ও লবন এর ব্যাপারে সতর্ক থাকি, ধূমপান না করি, অ্যালকোহল হতে দূরে থাকি সেই সাথে নিয়মিত হাটার অভ্যাস করি এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখি তাহলে হৃদ রোগ তথা সকল অসংক্রামক রোগের হাত থেকে আমরা নিরাপদ থাকব।


হৃদ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাঃ-


জন্মগত হৃদ রোগ এর পাশাপাশি ইকোকার্ডিওগ্রাম করে করোনারি ডিজিস বা হার্ট দুর্বল আছে কিনা তা নির্ণয় করা যায় এবং আমাদের দেশে সফল ভাবে সকল জন্মগত হৃদ রোগ এর চিকিৎসা করা হচ্ছে ।


৪০ বছরের (উদ্ধে) যাদের বয়স তাদের একটা এক্সজিকিউটিভ কার্ডিয়াক চেকআপ করা দরকার, এক্সজিকিউটিভ কার্ডিয়াক চেকআপ এর মধ্যে আছে ব্লাড সুগার, সিরাম লিপিড প্রোফাইল, ECG, ETT, থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট (TSH) এ সকল পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে বোঝাযায় হার্ট এ কোন সমস্যা আছে কিনা। আরো সুনিশ্চিত এবং সুনির্দিষ্ট জানার জন্য করোনারি এঞ্জিওগ্রাম (CAG) (হার্ট এর রক্তনালী পরীক্ষা) করা হয়; আমাদের দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রায় সবখানে এই পরীক্ষাটি করা যায়। কার্ডিয়াক এঞ্জিওগ্রাম এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি হার্ট এর কোন রক্তনালীতে ব্লক আছে কিনা, যদি ব্লক থেকে থাকে তবে তা ঔষধ সেবনে স্বাভাবিক হবে নাকি সার্জারি করতে হবে। সাধারণত বাইপাস সার্জারির মাধ্যমে খুব সহজে শরীর হতেই রক্তনালী নিয়ে হার্ট এ প্রতিস্থাপন করা হয়। বাইপাস সার্জারি সুনিপুণ ভাবে করলে একজন মানুষ সুন্দর ভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে; তার আর দ্বিতীয়বার বাইপাস সার্জারি করার প্রয়োজন হয়না।


কার্ডিয়াক সার্জন এর ভুমিকা চিকিৎসাঃ-


একজন সার্জনের দক্ষতা এবং নিপুণতার উপর সার্জারির ফলাফল অনেক অংশেই নির্ভরশীল। হার্ট সার্জন যদি নিখুঁত ভাবে সার্জারি শেষ করে তাহলে এর ফলাফল অত্যন্ত ভালো একই সাথে দীর্ঘমেয়াদী হয়। একটি বাইপাস সার্জারি একজন সার্জনের একক হাতে করা উত্তম এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক বাবুর্চি মিলে একটি রান্না করলে যেমন স্বাদ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, তেমনি অনেক সার্জন কাজ ভাগকরে নিয়ে একটি সার্জারি করলে গুনগত মান এর ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়।


আমি সার্জনদের বলব You should be very careful in the stage of wound making and wound closing. কারন ক্ষত তৈরি ও বন্ধ করার সময় যেকোন ভুলের কারনে ইনফেকশন হতে পারে। অনেক সময় বিভিন্ন কারনে এই দুটি কাজ সিনিয়র সার্জন করতে চান না ঠিক তখনই বিপত্তি ঘটে। ক্ষত বন্ধ করার সময় জুনিয়র সার্জনরা অনেক টাইট করে ফেলে; সাপে কাটা রোগীর অঙ্গ অনেক সময় ধরে বেঁধে রাখার কারনে যেমন গ্যাংরিন (পচন ধরা) হয়, একটি টাইট wound closing এর ফলে রক্ত চলাচল সঠিক নিয়মে করতে পারবেনা এবং ইনফেকশন হবেই। এ বিষয়ে আমি সার্জনদের অনুরোধ করব তারা যেন শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সময় নিয়ে একক হাতে যত্নের সাথে সুনিপুণ ভাবে সার্জারি সম্পূর্ণ করে।


বাইপাস সার্জারির পরে যত্ন ও সুস্থ জীবন যাপনঃ-


বাইপাস সার্জারির পরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইমিডিয়েট কেয়ার বা তৎক্ষণাৎ যত্ন যেগুলো হাসপাতালে থাকা কালীন সময় নিতে হয় যেমন ঠিকমত হাটা-চলা করা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, যাতে কোন ধরনের ইনফেকশন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।


কয়েকটি নিয়ম বাইপাস সার্জারি করা রোগীকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে –


  • নিয়মিত হাটা কমপক্ষে ৩০ মিনিট।
  • খারারের প্রতি সচেতন থাকা।
  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  • ধূমপান থেকে বিরত থাকা।

এক কথায় পরিমিত খাদ্য, নিয়মিত হাটা, ধূমপান পরিহার, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ।